রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর | জ্ঞানচক্ষু (গল্প) আশাপূর্ণা দেবী – মাধ্যমিক বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর | Madhyamik Bengali Question and Answer :
1. কিন্তু নতুন মেসোকে দেখে জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল তপনের । —নতুন মেসোর পরিচয় দাও । তাকে দেখে তপনের জ্ঞানচক্ষু খুলে যাওয়ার কারণ কী ?
Ans: ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পে তপনের নতুন মেসো তার ছোটোমাসির স্বামী । তিনি একজন লেখক , বই লেখেন । ইতিমধ্যে তাঁর অনেক বই ছাপাও হয়েছে । সর্বোপরি তিনি একজন প্রফেসর ।
তপনের ছোটোমাসির বিয়ের পর নতুন মেসো যে লেখক , এ কথা শুনে তার কৌতূহলের অন্ত ছিল না । তার কাছে লেখক মানে ভিন গ্রহের কোনো মানুষ , যারা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে । একজন লেখককে যে এত কাছ থেকে দেখা যায় কিংবা লেখকরা যে তপনের বাবা , ছোটোমামা বা মেজোকাকুদের মতো সাধারণ মানুষ হতে পারে , এ বিষয়েও তার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল । কিন্তু তার সেই ধারণাগুলো ভেঙে গেল , যখন দেখল তার ছোটোমেসোও তার বাবা , ছোটোমামা বা মেজোকাকুর মতোই দাড়ি কামান , সিগারেট খান , খেতে বসে অর্ধেক খাবার তুলে দেন , সময়মতো স্নান করেন ও ঘুমোন । ছোটোমামাদের মতোই খবরের কাগজের কথায় তর্ক ও শেষ পর্যন্ত দেশ সম্পর্কে একরাশ হতাশা ঝেড়ে ফেলে সিনেমা দেখতে বা বেড়াতে চলে যান । এসব বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে মেসোর মিল দেখে তপনের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয় । সে বুঝতে পারে লেখকরা আকাশ থেকে পড়া জীব নয় , নিছকই মানুষ ।
2. ‘ রত্নের মূল্য জহুরির কাছেই ।’— ‘ রত্ন ’ ও ‘ জহুরি বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? উদ্ধৃত উক্তিটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও ।
Ans: আশাপূর্ণা দেবীর ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পে উদ্ধৃতিটি পাই । ‘ রত্ন ’ বলতে মূল্যবান পাথর বোঝায় । ‘ জহুরি ‘ বলতে বোঝায় জহর অর্থাৎ রত্ন বিশেষজ্ঞকে । যে – কোনো পাথরকে রত্ন বলে চালালে তা জহুরির চোখ এড়ানো মুশকিল । ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পে ‘ রত্ন ‘ বলতে তপনের লেখা গল্পকে আর ‘ জহুরি ‘ বলতে তার ছোটোমাসির স্বামী তথা নতুন মেসোমশাইকে বোঝানো হয়েছে ।
সীমিত জীবনবৃত্তের পরিধিতে তপনের গল্পের বইয়ের সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও লেখকদের সম্পর্কে তার কিছুই অভিজ্ঞতা ছিল না । তপন তাদের গ্রহান্তরের কোনো জীব ভাবত । নতুন মাসির বিয়ের পর লেখক নতুন মেসোর সঙ্গে যখন পরিচিত হল তখনই তপনের লেখক সম্পর্কে সমস্ত ধারণা বদলে গেল । তার জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল । তপন তার বাবা , কাকা ও মামাদের সঙ্গে নতুন মেসোর কোনো তফাত পেল না । এসব কিছু মিলিয়েই তপন ভাবে তারই বা লেখক হতে বাধা কোথায় ? তাই সে গল্প লিখতে গিয়ে আস্ত একটা গল্প লিখে ফেলায় উত্তেজনায় ছোটোমাসিকে দেখায় । ছোটোমাসি তা মেসোকে ঘুম থেকে তুলে দেখায় । ব্যাপারটায় তপনের মত না থাকলেও সে মনে মনে পুলকিত হয় , কেন – না জহুরির রত্ন চেনার মতো তার লেখার কদর একমাত্র নতুন মেসোই বুঝতে পারবে ।
3. ‘ আর সবাই তপনের গল্প শুনে হাসে । সকলের তপনের গল্প শুনে হাসার কারণ কী ? তার গল্পের যথাযথ মূল্যায়ন কে , কীভাবে করেছিলেন ?
অথবা ,
বিকেলে চায়ের টেবিলে ওঠে কথাটা । চায়ের টেবিলে ওঠা কথাটি সম্পর্কে বাড়ির মানুষদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ? নতুন মেসোরই – বা
এই ঘটনায় বক্তব্য কী ছিল ? হাসার কারণ ?
Ans: ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্প থেকে গৃহীত অংশটিতে ‘ সবাই ’ বলতে তপনের বাড়ির লোকজনকে বোঝানো হয়েছে । বাড়ির বড়োদের চোখে সে ছিল নেহাতই ছোটো , তার গুরুত্ব কম । সে যে রাতারাতি একটা গল্প লিখে ফেলতে পারে , আর সে – গল্প যে ছাপানোর যোগ্য হতে পারে তা প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি । তাই সকলে তপনের গল্প শুনে হেসেছিলেন । বাড়ির সকলে তার লেখা গল্পকে গুরুত্ব না দিলেও , তার লেখক নতুন মেসো কিন্তু এই গল্পের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন । তপনের মাসি তার গল্পটি মেসোকে দেখালে , তিনি তা একটি পত্রিকায় গল্পের মূল্যায়ন কে , কীভাবে করেছিলেন ? প্রকাশ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন । বিকেলে চায়ের টেবিলে সকলে তপনের লেখা গল্প নিয়ে হাসাহাসি ত করলেও , লেখক – মেসো কিন্তু তপনের প্রশংসা করেন । তিনি বলেন যে , না তপনের লেখার হাত ও দেখার চোখ দুই – ই আছে । কারণ তার বয়সি ছেলেমেয়েরা সাধারণত রাজারানি , খুন , জখম , অ্যাকসিডেন্ট , নয়তো না – খেতে পেয়ে মরে যাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে গল্প লেখে । কিন্তু তপন সেসব না – লিখে তার ভরতি হওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়ে গল্প লিখেছে । তপনের লেখক মেসোর মতে , এ খুব বিরল লক্ষণ । এইভাবে তপনের মেসো তার লেখা গল্পের মূল্যায়ন করেছিলেন । তবে তপনের গল্পে আনাড়ি হাতের ছাপ থাকায় , তিনি তা সংশোধন করে দিয়েছিলেন ।
4. পৃথিবীতে এমন অলৌকিক ঘটনাও ঘটে ? – কোন্ ঘটনাকে অলৌকিক বলা হয়েছে । একে অলৌকিক বলার কারণ কী ?
Ans: প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর গল্প ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ – র কেন্দ্রীয় চরিত্র তপন । বিশাল পৃথিবীতে স্বল্প বাস্তবতাবোধ নিয়ে আর পাঁচটা শিশুর মতোই তারও পথ চলা । লেখকদের সম্পর্কে তার ধারণা সে – কথাই বলে । সেই তপন তার নতুন লেখক মেসোমশাইয়ের অলৌকিক ঘটনা সান্নিধ্যে এসে তার প্রতিভাকে বিকশিত করে কাঁচা হাতে লিখে ফেলে একটা আস্ত গল্প । সেই গল্প মেসোর হাতে গেলে মেসো তপনের ও বাড়ির লোকেদের মন রাখার জন্য তা সামান্য কারেকশন করে সন্ধ্যাতারা ‘ পত্রিকায় ছাপিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন ও সেটি নিয়ে যান । এর বেশ কিছু দিন পর ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ পত্রিকায় গল্পটি ছেপে বেরোয় । তপনের কাছে এই চমকপ্রদ ঘটনাটিই অলৌকিক বলে মনে হয়েছিল । → ‘ অলৌকিক ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল মানুষের পক্ষে যা সম্ভব নয় বা পৃথিবীতে সচরাচর যা ঘটে না । এক্ষেত্রে ছোট্ট তপনের লেখা গল্প কেন অলৌকিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সমন্বয়ে যেভাবে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল সেটাই অলৌকিক । আসলে তপনের লেখক সম্পর্কে ধারণার অবসান , গল্প লেখা , তা মেসোর হাত ধরে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়া প্রভৃতি ঘটনাগুলি তার কাছে এতটাই অবিশ্বাস্য যে , তার মনে হয় সমস্ত ঘটনাটিই যেন অলৌকিক ।
5. ‘ এর প্রত্যেকটি লাইনই তো নতুন আনকোরা , তপনের অপরিচিত ’ – ‘ এর ’ বলতে কীসের কথা বলা হয়েছে । বিষয়টি পরিস্ফুট করো ।
Ans: উদ্ধৃত লাইনটি আশাপূর্ণা দেবীর ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পের অংশবিশেষ । ‘ এর ‘ – এর উদ্দেশ্য এখানে ‘ এর ’ বলতে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তপনের প্রথম ছেপে বেরোনো গল্প ‘ প্রথম দিন ‘ – এর কথা বলা হয়েছে । গল্পের নায়ক তপন ছোটোবেলা থেকেই ভাবত লেখকরা বুঝি অন্য জগতের মানুষ । কিন্তু ছোটোমাসির সঙ্গে বিয়ে হওয়া নতুন মেসোকে দেখে তার সেই ভুল ভাঙে । তার নতুন মেসো বই লেখেন । সেসব বই ছাপাও হয় — অথচ মেসোর আচার – আচরণের সঙ্গে তার বাবা , ছোটোমামা বা মেজোকাকুর আচার – আচরণের কোনো তফাতই বিস্তারিত আলোচনা সে খুঁজে পায় না । তপন বোঝে , লেখকরা আকাশ থেকে পড়া কোনো জীব নয় । অনুপ্রাণিত তপন একটা আস্ত গল্প লেখে যেটা তার মাসির হাত ঘুরে মেসোর হাতে পড়ে । মাসির পীড়াপীড়িতে সামান্য কারেকশন করে সে গল্প ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ – য় ছাপিয়ে দেন নতুন মেসো । বাড়িতে সে নিয়ে আনন্দের শেষ নেই । কিন্তু ছোট্ট তপন সকলের অনুরোধে গল্প পড়তে শুরু করতেই সুর কেটে যায় । তপন দেখে কারেকশনের নাম করে মেসো তার লেখাটা আগাগোড়াই বদলে দিয়েছেন । গল্পের প্রত্যেকটি লাইনই তার কাছে নতুন লাগে । তার শিশুমন ব্যথায় ভরে ওঠে ।
6. ‘ তপনের মনে হয় আজ যেন তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন।— ‘ আজ ’ বলতে কোন দিনের কথা বলা হয়েছে । তপনের এমন মনে হওয়ার কারণ কী ?
Ans: ‘ আজ ‘ বলতে সেই দিনটির কথা বলা হয়েছে , যেদিন তপনের মাসি ও মেসো ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ পত্রিকার একটি সংস্করণ নিয়ে তাদের বাড়িতে আসেন , যাতে তপনের প্রথম ‘ আজ ‘ –যে দিন গল্প প্রকাশিত হয় ।
কারণ শিশুমন কোমল , সামান্য আঘাত পেলেই তারা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ে । এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে । ছোট্ট তপনের লেখক সম্পর্কে সব কৌতূহলের শেষ হয় নতুন মেসোকে দেখে । অনুপ্রাণিত তপন একটি গল্প লেখে । সেই গল্প মাসির পীড়াপীড়িতে মেসোর হাত ধরে ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ পত্রিকায় ছাপা হয় । স্বাভাবিক কারণে তপন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে । নানান বিরুপতা সত্ত্বেও সে গর্ব অনুভব করে । কিন্তু তার গর্ব মাটিতে মিশে যায় গল্পটি পড়ার সময় । সে দেখে প্রকাশিত গল্পে তার লেখার লেশমাত্র নেই । কারণ গল্পটা সামান্য কারেকশনের নামে পুরোটাই বদলে গিয়েছিল । এতে তপনের লেখকসত্তা অপমানিত হয় । তার চোখে জল এসে যায় । এই কারণে দিনটিকে তার সবচেয়ে দুঃখের মনে হয় ।
7. ‘ জ্ঞানচক্ষু গল্পে তপন চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো ।
Ans: আশাপূর্ণা দেবীর ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পের তপনের মধ্যেও সব শিশুর মতোই আশা – আকাঙ্ক্ষা , স্বপ্ন – স্বপ্নভঙ্গ , কল্পনা বাস্তব , আনন্দ – অভিমানের টানাপোড়েন দেখা যায় । তবে তার চরিত্রের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য তাকে আলাদা করে রাখে । তপন মনে মনে তার কল্পনার জগৎকে সাজিয়ে নিতে ভালোবাসে । তাই তার কল্পনার জগতে লেখকরা ছিলেন ভিন কল্পনাপ্রবণ গ্রহেরপ্রাণী । সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তাদের বুঝি বা কোনো মিলই নেই । সাহিত্যপ্রেমী সাহিত্যের প্রতি তপনের ঝোঁক ছোটোবেলা থেকেই । সে অনেক গল্প শুনেছে ও পড়েছে । লেখকদের সম্পর্কেও তার কৌতূহল অসীম । ছোটোমেসোকে দেখে তার মনেও লেখক হওয়ার ইচ্ছে জাগে । উৎসাহী হয়ে বেশ কয়েকটা গল্পও লিখে বয়স অনুপাতে তপন একটু বেশিই সংবেদনশীল । সমবয়সি ছেলেমেয়েদের মতো রাজারানি , খুন – জখম ও অ্যাকসিডেন্ট নিয়ে না – লিখে , তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি সংবেদনশীল ও অন্তর্মুখী ২ ঠাট্টাতামাশা বা মাসি মেসোর উৎসাহদান কোনোটাতেই সে প্রকাশ্যে তার প্রতিক্রিয়া দেখায় না । এটা তার অন্তর্মুখী স্বভাবেরই পরিচয় । তাই কারেকশনের নামে মেসো তার গল্পটা আগাগোড়া বদলে দিলে তপন তার কষ্ট লুকোতে ছাদে গিয়ে কাঁদে ।
তপনের আত্মমর্যাদা বোধ ছিল প্রবল । তার গল্প ছোটোমেসো কারেকশনের নাম করে আগাগোড়াই বদলে দিলে তপনের লেখকসত্তা আহত হয় । সে মনে মনে শপথ নেয় , ভবিষ্যতে লেখা ছাপাতে হালে সে নিজে গিয়ে লেখা দিয়ে আসবে পত্রিকা অফিসে । তাতে যদি তার মতো নতুন লেখকের লেখা ছাপা না হয় , তাতেও দুঃখ নেই ।
8. নতুন মেসোর চরিত্রটি আলোচনা করো ।
Ans: কথাশিল্পী আশাপূর্ণা দেবী রচিত ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পের মূল চরিত্র তপনের আত্মোপলব্ধির পিছনে যে – চরিত্রটির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে , তিনি হলেন তপনের নতুন মেসো । এই মেসো পেশায় অধ্যাপক এবং লেখক । তাঁর লেখক পরিচয় তপনের মনের বহু ভুল ধারণা ভেঙে দেয় । অধ্যাপক ও লেখক হওয়া সত্ত্বেও মেসো ব্যক্তিটি বেশ মিশুকে , ফুর্তিবাজ । তিনি শ্যালক – শ্যালিকাদের সঙ্গে গল্প করেন , তর্ক করেন , কবজি ডুবিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন , সিনেমায় মিশুকে যান ও বেড়াতেও যান ।
শ্বশুরবাড়ির সদস্য হিসেবে তপনের প্রথম লেখা গল্পের তিনি প্রশংসা সহানুভূতিশীল করেন ও তা ছাপার দায়িত্ব নিয়ে নেন । শুধু যে তপনকে উৎসাহ দিতে ছোটোমেসো তার গল্পটা ছাপিয়ে দেন , নিজের প্রতিপত্তি এমনটা নয় । শ্বশুরবাড়িতে নিজের প্রতিপত্তি জাহির বাহিরে আগ্রহী করতেও তিনি এ কাজ করেন । তপনের গল্প যাতে প্রসিদ্ধি পায় , তাই সংশোধনের নামে গল্পের খোলনলচে বদলে দেন মেসো । তাঁর উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ ছিল । কিন্তু তাঁর অন্যের আবেগ বুঝতে অক্ষম এই উদ্যোগ তপনের লেখকসত্তাকে আঘাত করে । একদিকে চারিত্রিক উদারতায় ও মহত্ত্বে আবার অন্যদিকে অসতর্কতায় , তপনের নতুন মেসো এক পরিপূর্ণ রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে ওঠেন । যদিও একজন লেখক হয়ে অন্য লেখকের এই আত্মসম্মান ও অহংবোধকে উপলব্ধি করা তাঁর উচিত ছিল ।
9. তপনের ছোটোমাসির চরিত্রটি আলোচনা করো ।
অথবা
জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পে তপনের ছোটোমাসির স্বভাব ও ভাবনার যে – পরিচয় ফুটে উঠেছে , আলোচনা করো ।
Ans: ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পে আশাপূর্ণা দেবী সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে ছোটো অথচ বেশ শক্তিশালী চরিত্র হল তপনের ছোটোমাসির চরিত্রটি । ছোটোমাসি বয়সে তপনের চেয়ে বছর আষ্টেকের বড়ো । প্রায় সমবয়সি ছোটোমাসি ছিল তপনের চিরকালের বন্ধু । মামার বাড়িতে এলে তপনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গী ছিল সে । তাই তপন প্রথমবার গল্প লিখে বন্ধুত্বপূর্ণ ছোটোমাসিকেই সকলের আগে দেখায় । সদ্যবিবাহিতা ছোটোমাসির স্বামী একজন অধ্যাপক । তিনি আবার বইও লেখেন । তাই বিয়ের পর থেকে ছোটোমাসির মধ্যে একটা মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব এসেছে । তপনের লেখা গল্পটি পুরোটা না পড়েই স্বামী গর্বে গর্বিতা সে তার মতামত জানায় এবং লেখাটা নিয়ে যায় । তার স্বামীর কাছে । তার জোরাজুরিতেই তার স্বামীর তপনের গল্পটা ছাপানোর ব্যবস্থা করতে রাজি হয়ে যান । তাই সেই গল্প ‘ সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় ছেপে বেরোলে মাসির মুখে আত্মপ্রসাদের আনন্দ দেখা যায় । প্রায় সমবয়সি হলেও তপন ছিল তার বিশেষ স্নেহের পাত্র । তাই তার লেখা গল্প ছাপানোর ব্যাপারে মাসি এত উদ্যোগ । নেয় । সে যখন মজা করে তপনের লেখাটা ‘ টুকলিফাই ’ কিনা জানতে চায় , তখনও সেই বক্তব্যের মধ্যে অভিযোগ বা সন্দেহের বদলে স্নেহেরই সুর বাজে ।
10. ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পের গৌণ চরিত্রগুলি গল্পে কী ভূমিকা পালন করেছে , তা আলোচনা করো ।
Ans: আশাপূর্ণা দেবী রচিত ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পে যেসব গৌণ চরিত্রের দেখা মেলে তারা হলেন তপনের ছোটোমামা , মেজোকাকু , মা এবং তার বাবা । এই চরিত্রগুলির মধ্যে একমাত্র ‘ ছোটোমামা ‘ চরিত্রটির মুখে কোনো সংলাপ দেখতে পাওয়া যায় না । বাকিদের ক্ষেত্রেও সংলাপ অতিসামান্য । তবে কমবেশি সবকটি চরিত্রই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বয়সজনিত পরিণতমনস্কতা লক্ষ করা যায় না । তপনের বয়সি কোনো ছেলে প্রথম গল্প লিখলে বা সেই গল্প ছাপা হলে যেভাবে তাকে উৎসাহ ও প্রশংসা দেওয়া উচিত , তা এই অভিভাবকস্থানীয় ব্যক্তিরা করেননি । উলটে ব্যঙ্গ ও রসিকতায় তাকে জড়োসড়ো ও আড়ষ্ট তুলেছেন । একমাত্র তপনের মাকেই ছেলের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হতে দেখা যায় । তবে লেখিকা আগাগোড়া রসিকতার ঢঙে গল্পটি পরিবেশন করায় | গল্পের গৌণ চরিত্রগুলিও আবহের সঙ্গে বেশ মানানসই । আসলে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে একটি কল্পনাপ্রবণ ও সৃষ্টিশীল বালকের প্রকৃত অসহায় অবস্থা ফুটিয়ে তুলতে দৈনন্দিনতার যে আটপৌরে ছবিটির প্রয়োজন | হয় , এই চরিত্রগুলির মাধ্যমে লেখিকা মুনশিয়ানার সঙ্গে সেই পরিবেশটাই স্পষ্ট করে তুলেছেন ।
11. ছোটোগল্প হিসেবে আশাপূর্ণা দেবী রচিত ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পের সার্থকতা বিচার করো ।
Ans: শুধু আয়তনে ছোটো হলেই কোনো গল্প ছোটোগল্পের পর্যায়ে পড়ে না । ছোটোগল্পের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে । সেই বৈশিষ্ট্যগুলির সাপেক্ষে ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পটিকে বিচার করলে বোঝা যাবে ছোটোগল্প হিসেবে সেটি কতটা সার্থক ।
ছোটোগল্প শুরু হয় হঠাৎ করে । ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পতেও এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ করা যায় । ‘ কথাটা শুনে তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেল’— এই বাক্যটি দিয়ে আচমকাই গল্পটি শুরু হয় । হঠাৎ শুরু গল্প লেখাকে কেন্দ্র করে তপনের মোহ এবং সেই মোহভঙ্গের কাহিনিকে ঘিরেই এই গল্প । গল্পে অন্য কোনো উপকাহিনি গড়ে একটি মাত্র য় বিষয়কেন্দ্রিকতা ওঠেনি । তাই গল্পটি তার সংক্ষিপ্ত পরিধির মধ্যে একটি মাত্র বিষয়েই সীমাবদ্ধ । ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পে তপন ছাড়াও যে চরিত্রগুলির ভূমিকা নজর কাড়ে , তাঁরা হলেন তপনের ছোটোমাসি এবং মেসো । বাকি কম চরিত্রের উপস্থিতি চরিত্রগুলি নেহাতই গৌণ । এক্ষেত্রেও ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে । অতিরিক্ত চরিত্রের ভিড় নেই । ছোটোগল্প যেমন হঠাৎ করে শুরু হয় , তেমনই হঠাৎই শেষ হয় । গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও পাঠকের মনে এক ধরনের অতৃপ্তি থেকে যায় । ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয় । ছাপার অক্ষরে অসমাপ্তির রেশ নিজের নামের মতোই নিজের লেখাকেও দেখতে চেয়েছিল তপন । তার সেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়েই গল্পটি শেষ হয় । ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পটির মধ্যে ছোটোগল্পের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই রয়েছে । সুতরাং , ছোটোগল্প হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে সার্থক ।
12. নতুন মেসোকে দেখে জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল তপনের— প্রশ্ন কোন্ ঘটনায় জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল ?
Ans: গল্প অনুসারে সত্যিই কি এই ঘটনায় তপনের জ্ঞানচক্ষু খুলেছিল ? জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনের গল্পকার আশাপূর্ণা দেবীর ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পের প্রধান চরিত্র তপন । তার শিশুমনে লেখক বা সাহিত্যিক সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না । সে ভাবত লেখকেরা বুঝি কোনো ভিন গ্রহের জীব । ছোটোমাসির বিয়ে হওয়ার পর তপন জানতে পারে নতুন মেসো একজন লেখক এবং তাঁর অনেক বই ছাপা হয়েছে । জলজ্যান্ত একজন সত্যিকারের লেখককে চোখের সামনে দেখে সে বুঝতে পারে লেখকেরা ছোটোমামা কিংবা মেজোকাকুর মতোই নিছক সাধারণ মানুষ । এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তপনের প্রাথমিক জ্ঞানচক্ষু খুলে যায় । জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনে ঘটনার প্রেক্ষিত
লেখক মেসোমশাইয়ের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তপন নিজেও একটা আস্ত গল্প লিখে ফেলে । এভাবে সহজেই একটা গল্প লিখে ফেলার রোমাঞে ও উত্তেজনায় তা সে বন্ধুমনোভাবাপন্ন ছোটোমাসিকে দেখায় । এরপর ছোটোমাসির প্ররোচনায় আর নতুন মেসোর প্রভাবে সেই গল্পটি ‘ সন্ধ্যাতারা ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । কিন্তু পত্রিকায় ছাপা গল্পটি পড়ে তপন টের পায় সংশোধনের নামে মেসো লেখাটির আগাগোড়া বদলে দিয়েছেন । এ গল্পে তপন কোথাও নেই । আর বাড়িতেও মুখে মুখে রটে যায় মেসোর দৌলতেই তার গল্প ছাপা হয়েছে । এ ঘটনা আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন তপনের সংবেদনশীল লেখক মনে আঘাত করে । লজ্জায় অনুশোচনায় সে সিদ্ধান্ত নেয় ভবিষ্যতে কারও সুপারিশে নির্ভর না করে নিজের লেখা নিজেই ছাপতে দেবে । এক কিশোরের আত্মস্বরূপ আবিষ্কারের এ কাহিনির মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে প্রকৃত জ্ঞানচক্ষু লাভের সার্থকতা ।
13. তার চেয়ে দুঃখের কিছু নেই , তার থেকে অপমানের ! – কার এ কথা মনে হয়েছে ? জীবনের কোন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে ?
অথবা ,
তার চেয়ে দুঃখের কিছু নেই , তার থেকে অপমানের ।– উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে কোন্ ঘটনা কেন দুঃখের ও অপমানের ।
Ans. কথাশিল্পী আশাপূর্ণা দেবীর ‘ জ্ঞানচক্ষু ’ গল্পের নায়ক তপনের এ কথা মনে হয়েছিল । শিশুমন কোমল , সামান্য আঘাত পেলেই তারা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ে । এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে । ছোট্ট তপনের লেখক সম্পর্কে সব কৌতূহলের শেষ হয় নতুন মেসোকে দেখে । অনুপ্রাণিত তপন একটি গল্প লেখে ।
সেই গল্প মাসির পীড়াপীড়িতে মেসোর হাত ধরে ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ পত্রিকায় ছাপা হয় । স্বাভাবিক কারণে তপন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে । নানান বিরূপতা সত্ত্বেও সে গর্ব অনুভব করে । কিন্তু তার গর্ব মাটিতে মিশে যায় গল্পটি পড়ার সময় । সে দেখে প্রকাশিত গঙ্গে তার লেখার লেশমাত্র নেই । কারণ গল্পটা সামান্য কারেকশনের নামে পুরোটাই বদলে গিয়েছিল । এতে তপনের লেখকসত্তা অপমানিত হয় । তার চোখে জল এসে যায় । নিজের গল্প পড়তে বসে অন্যের লেখা লাইন পড়ার দুঃখ ও যন্ত্রণা তাকে কুরেকুরে খায় । লজ্জা , অনুশোচনা এবং আত্মসম্মানহীনতার সংকোচ থেকে এভাবেই সে উপরিউক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় ।
14. ‘ জ্ঞানচক্ষু গল্পে জ্ঞানচক্ষু বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? গল্পটি পড়ে তুমি কী শিক্ষা পেলে লেখো ।
Ans: ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পটির লেখিকা কথাশিল্পী আশাপূর্ণা দেবী । তিনি জ্ঞানচক্ষু কী ? জ্ঞানচক্ষু ’ বলতে মানুষের আত্ম – অনুভূতি এবং অন্তদৃষ্টি লাভের বিষয়টিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন । ” জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পটির নায়ক তপন । ছোট্ট তপন তার সীমিত জীবনবৃত্তে কখনও কোনো লেখককে দেখেনি । তাই সত্যিকারের লেখক নতুন মেসোকে দেখে সাহিত্যিক সম্পর্কে তার সমস্ত ভুল ধারণার নিরসন হয় । মেসোকে হাতের কাছে পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে সে নিজেই এবার একটা আস্ত গল্প লিখে ফেলে ।
এরপর মাসির প্রশ্রয়ে এবং লেখক মেসোর প্রভাবে সেই গল্পটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । সে মনে মনে বেশ গর্বও অনুভব করে । কিন্তু ছাপা লেখাটি পড়তে গিয়ে টের পায় সংশোধন করতে গিয়ে লেখক – মেসো গল্পের আগাগোড়া বদলে দিয়েছেন । নির্বিচারে কলম চালানোয় নিজের নামে সঙ্গ পড়ে প্রাপ্ত শিক্ষা ছাপানো গল্পে সে আর নিজেকেই কোথাও খুঁজে পায় না । ফলে তপনের লেখকমন আহত হয় । সে দুঃখে , লজ্জায় ও অসম্মানে একলা হাতে গিয়ে কেঁদে ফেলে । এমন গভীর খারাপ লাগার দিনে দাঁড়িয়ে সে সংকল্প করে ; ভবিষ্যতে কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের লেখা নিজেই ছাপতে দেবে । আসলে কাউকে অবলম্বন করে কিছু পেতে গেলে যে আত্মসম্মান খুইয়ে নিজের মনের আয়নায় নিজেকেই ছোটো হয়ে যেতে হয় এই শিক্ষাই তপন লাভ করে আর আমরাও তার সঙ্গে টের পাই স্বকীয়তা এবং আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে আপস করে কখনই জীবনে কিছু লাভ করা যায় না ।
15. ” তপন আর পড়তে পারে না । বোবার মতো বসে থাকে – তপনের এরকম অবস্থার কারণ বর্ণনা করো ।
Ans: আশাপূর্ণা দেবীর ‘ জ্ঞানচক্ষু ‘ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তপনের ইচ্ছে ছিল লেখক হওয়ার । একই সঙ্গে লেখকদের সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল , তাঁরা বুঝি আকাশ থেকে পড়া অতিলৌকিক কোনো প্রতিভা । কিন্তু তার ছোটোমাসির বিয়ের পর নতুন মেসোকে দেখে তার সেই ভুল ভাঙে । তার নতুন মেসো অধ্যাপক , বই লেখেন । সেসব বই ছাপাও হয় অথচ প্রান্তিক মাধ্যমিক বাং মেসোর আচার – আচরণের সঙ্গে তার বাবা , ছোটোমামা বা মেজোকাকুর আচার – অচারণের কোনো তফাতই সে খুঁজে পায় না । নতুন মেসোকে দেখে অনুপ্রাণিত তপন একটি আস্ত গল্প লেখে , যেটি তার মাসির হাত ঘুরে মেসোর হাতে গিয়ে পড়ে । মাসির পীড়াপীড়িতে সামান্য কারেকশন করে সেই গল্প ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ পত্রিকায় ছাপানোর আশ্বাস দেন নতুন মেসো । বাড়িতেও সে নিয়ে আনন্দের শেষ নেই । অনেকদিনের ইচ্ছে হয়তো এবার পূরণ হতে চলেছে — এই ভেবেই একটু সংশয়কে সঙ্গী করেই তপনের মনও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে । কিন্তু যথাসময়ে ‘ সন্ধ্যাতারা ‘ – য় ছাপা লেখাটি পড়তে গিয়ে তপন টের পায় কারেকশনের নামে লেখক – মেসো গল্পের আগাগোড়া বদলে দিয়েছেন । নির্বিচারে কলম চালানোয় নিজের নামে ছাপানো গল্পে সে আর নিজেকেই খুঁজে পায় না । তপনের লেখকমন আহত হয় । নিজের গল্প পড়তে বসে অন্যের লেখা লাইন পড়ার দুঃখযন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খায় । লজ্জা , অনুশোচনা আর আত্মসম্মানহীনতায় তার বাক্রোধ হয়ে আসে ।